"যে কথা আর হবে না বলা কোনদিন"
লিখেছেন লিখেছেন আমীর আজম ১৯ এপ্রিল, ২০১৪, ১২:০১:৪৬ রাত
অনেকগুলো অংক করে নিয়ে এসে বাবাকে দেখাল তমাল। বাবা খুব খুশি হলেন। একটা সিগনেচার দিয়ে ভেরি গুড লিখে দিলেন। তমাল অবাক হয়ে সিগনেচারের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবাকে জিজ্ঞেস করে :
- এটা কি জিনিস বাবা ?
বাবা মৃদু হাসেন। বলেন :
- এটা হল আমার স্পেসিমেন সিগনেচার। তুই যখন বড় হবি তখন তোকে চিঠি লিখব। ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে বলব। আরো অনেক কাগজে-পত্র তোর কাছে পাঠাব। সেগুলোতে এই সিগনেচারটা দিব। যদি এই সিগনেচার টা দেখিস তাহলে বুঝবি এটা আমি পাঠিয়েছি। এটা না থাকলে মনে করবি আমি পাঠাই নি।
- ওও।
- বড় হলে চিনতে পারবি না আমার সিগনেচার টা।
- হ্যাঁ। খুব পারব।
কন্ঠে অনেক আত্মবিশ্বাস তমালের। বাবা খুশি হয়ে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে দেন।
সেদিন থেকে তমালের চিন্তা- ভাবনা তারও একটা স্পেসিমেন সিগনেচার দরকার। কত খাতার পৃষ্ঠা শেষ করে ফেলেছে চেষ্টা করতে গিয়ে। কিন্তু তমাল অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছে তার সিগনেচার টা কেন জানি বাবার মত হয় না।
-----------------------------------------
একবার একটা খাতা নিয়ে আসতে বলেছিল তমাল বাবাকে। বাবা ব্যস্ত মানুষ। বারবার ভুলে যান। এভাবে পরপর তিনদিন নিয়ে না আসায় তমাল একদিন মুখ ফসকে বলেই ফেলল :
- কালকে যদি নিয়ে না আস তাহলে তুমি আমার বাবা না।
বাবা সবেমাত্র অফিস থেকে এসেছেন। অনেক ক্লান্ত। এ অবস্থায়ই আবার বাজারে ছুটলেন। খাতা নিয়ে আসলেন। তমালের হাতে দিয়ে বললেন :
- তুই আমাকে এ ধরনের কথা বলতে পারলি।
তমাল সেদিনই প্রথম তার বাবার চোখদুটি ছলছল করতে দেখল। বুঝতে পারল সে ভুল করেছে। কিন্তু সরি বলতে পারল না। কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগছিল।
---------------------------------
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে তমাল। বাসায় টিভি নাই। একবার ঈদে বাবা ঘোষণা করলেন এবার টিভি কিনবেন। কিন্তু একটা শর্ত আছে।
সবাই জিজ্ঞেস করল কি শর্ত।
বাবা বলল :
- টিভি কিনলে কেউ নতুন কাপড় পাবে না। আর যদি কাপড় কিনতে চাও তাহলে টিভি হবে না। তবে সিদ্ধান্ত অবশ্যই তমালের। সে যেটা বলবে সেটাই হবে।
বাসার সবাই তমালকে ধরল। টিভির কথা বলতে হবে। তমালও না বুঝে টিভির কথা বলে দিল।
বাসায় নতুন টিভি আসল। সবাই অনেক খুশি। কিন্তু ঈদের আগের দিন তমাল খেয়াল করল বাবা কেন জানি তার জন্যে এখনো নতুন জামা নিয়ে আসতেছে না। এদিকে পাড়া প্রতিবেশী সবার নতুন জামা কেনা শেষ। তারপর শুরু হল কান্না। সে কি কান্না !! থামার আর কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কি আর করার.? শেষমেষ বাবা আবার তাকে নিয়ে ছুটলেন বাজারে।
-------------------------------------
এরকম অসংখ্য টুকরো টুকরা ঘটনা মনে পড়ছে তমালের। আর হাসার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।
সে এখন বসে আছে একটা বিশাল পাথরের উপর। বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে। বুড়িমারী সীমান্ত। তার বাবা অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চাচা - মামারা সবাই ছোটাছুটি করছে। কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। তমালের ইচ্ছে করছে সেও কিছু একটা করবে। কিন্তু পারছে না। কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগছে।
তমাল আবার ভাবনার সাগরে ডুবে গেল।
---------------------------------
প্রতিদিনের মত সেদিনও যথারীতি স্কুল গিয়েছিল সে। ক্লাস ক্যাপ্টেন । অনেক দায়িত্ব। সবাইকে শান্ত রাখা, ব্লাকবোর্ড পরিস্কার রাখা,"চক - ডাস্টার রেডি রাখা। কত কাজ.!! অনেক চঞ্চল তমাল। সারা ক্লাস মাতিয়ে রাখে।
সেদিনও ক্লাসে অনেক হাসিখুশি ছিল তমাল। হঠাৎ স্কুলের দপ্তরী আসল। ক্লাস টিচারের হাতে একটা নোটিশ দিয়ে চলে গেল।
কোন একজন লোক অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে। এ জন্য সবার কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে। সাধারণত এ রকম কাজগুলোতে তমালের আগ্রহ সবচেয়ে বেশী। সে নিজেই সবার কাছ থেকে টাকা তুলে স্যারের কাছে জমা দিয়ে দেয়।
কিন্তু আজকে পারল না। কেন জানি ঘোষণা করা নামটা তার বাবার নাম হল। বাবা অবশ্য বেশ কিছুদিন থেকে অসুস্থ। বেশ কয়েকবার ডাক্তারের কাছেও গেছিল। হাসপাতালেও ভর্তি হয়ে ছিল কিছুদিন। বাসাতে একটা চাপা উত্তেজনা ছিল । কিছু একটা হচ্ছে তমাল বুঝতে পারে। কিন্তু কেউ তাকে কিছু বলে না। তমালও আর সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।
আজকে বুঝতে পারল বাসায় অনেক কিছু তার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। নিশ্চয়ই বাবার বড় কোন অসুখ হয়েছে। প্রিয় জিনিস হারানোর বেদনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। বুকের বা পাশটা চিনচিন করছে। হু হু করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তমালের।
মাথা নিচু করে বসে আছে তমাল। পাশে বসা ব্যাচমেট কি বুঝল কে জানে। উঠে দাড়িয়ে তমালের করণীয় কাজটা সে করে ফেললো।
"তাহলে কি সে ছাড়া সবাই জানে" -মনে মনে ভাবে তমাল। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে তার।
সেদিন সারা ক্লাসে একটা কথা বলে নি সে। চুপচাপ বাসায় চলে আসে। বাসাতেও আর কারো সাথে কথা বলে না। সবাই খেয়াল করে হাসিখুশি ছেলেটা কেন জানি নির্বাক হয়ে গেছে।
আজও পাথরের উপর নির্বাক বসে আছে সে।
-----------------------
তখন বয়স কত হবে তমালের। 13 নাহলে 14। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এ বয়সের মত বালাই পৃথিবীতে আর নাই। কথা মাত্রই প্রগলভতা। অল্প কথায় ন্যাকামী আর বেশী কথায় জ্যাঠামি।
তমালেরও হয়তো একই সমস্যা হয়েছিল। তাই আত্মীয় - স্বজনরা যখন ছোটাছুটি করেছিল তার বাবাকে নিয়ে, সে কিছুই করতে পারেনি। জ্যাঠামি হয়ে যাবে ভেবে।
পারেনি চোখের জলে কেদে কেদে বাবাকে বিদায় জানাতে। পারেনি বলতে, "আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি বাবা। " কি জানি ন্যাকামী হয়ে যায় কিনা ?
শুধু একা একা নিরবে চোখের পানি ফেলেছে।
আচ্ছা সেদিন যখন সে চুপচাপ একটা পাথরের উপর বসে ছিল লোকজন কি মনে করেছিল। তাকে কি সবাই নিষ্ঠুর ভেবেছিল। তারা কি বলেছিল - 'কি পাষণ্ড ছেলে। বাবা অসুস্থ। আর এ নিশ্চিন্তে বসে আছে।'
কি জানি ? হবে হয়তো। তমাল জানেনা।
আজ আর ছোট্ট তমাল নেই। সে এখন অনেক বড় হয়েছে। কথায়ও কোন প্রগলভতা নেই। সে জানে কিভাবে নিজের আবেগ অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে হয়। সে এখন চিৎকার করে বলতে পারে, 'আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি বাবা।'
কিন্তু বলে না। আগেও যেমন অপারগ ছিল এখনো সে অপারগ।
সে যে 'বালাই' বয়সেই হারিয়ে ফেলেছে তার প্রিয় বাবাকে। আর কখনোই বাবাকে ভালবাসার কথা বলতে পাবে না সে।
বিষয়: Contest_father
২৯০৩ বার পঠিত, ৩১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অসংখ্য ধন্যবাদ।
আন্তরিক অভিনন্দন .....
Congratulations !!
আপনাকে অনেক অভিনন্দন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন